👉 কুমার শানু তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের তুলনায় কেন এতো আলাদা, পপুলার ও এগিয়ে ছিলেন আজ সেই নিয়েই তারকনাথ দত্ত দাদার থেকে ধার করা এই সংগ্রহীত লেখা :- (পর্ব-১)
নব্বই দশকের অব্যবহিত পূর্ব থেকে শুরু হয়ে গোটা নব্বই দশক জুড়ে ভারতীয় সংগীত জগতে কুমার শানুর ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠা তাঁকে স্বর্ণযুগের গায়ককূলের যোগ্য উত্তরাধিকারীর সম্মানে ভূষিত করেছে। এমনটা বহুবার হয়েছে অতীতের সব নামকরা সংগীত শিল্পীদের সাথে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে শোনা গিয়েছে, এবং এখনও সেই ধারা যথারীতি অব্যাহত আছে। বহু মানুষ যখন কোন শিল্পীকে এই পর্যায়ের স্বীকৃতি দেন, তখন বুঝতে হবে তারা যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নিয়েছেন। কথায় আছে— Voice Of The People Is The Voice Of The God.
একটা সময় পর্যন্ত সাধারণ শ্রোতাদের ধারণা ছিল ‘আশিকী’ ছবিতেই কুমার শানুর প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। এতে করে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, কুমার শানুর প্রথম আত্মপ্রকাশ রীতিমত চমকপ্রদ ঘটনা। আসলে বিষয়টাকে এইভাবে ভাবলে গোটা বিষয়টার অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। বিপুল আয়তন অট্টালিকা যেমন একের পর এক ইঁট সাজিয়ে গড়ে ওঠে কুমার শানুর বিরাট প্রতিষ্ঠার পিছনেও তেমনি তিল তিল পরিমাণ করে সঞ্চিত নিষ্ঠা আর ধৈর্য্য কাজ করেছে। বস্তুত এই কাজে তাঁর মত পরিশ্রমের দৃষ্টান্ত ভারতীয় সংগীত জগতের ইতিহাসে দূর্লভ।
কুমার শানু তাঁর গোটা কেরিয়ারে অসংখ্য গান গেয়েছেন। তাঁর একাধিক ভাষায় গাওয়া বৈচিত্র্যময় গানের ভাণ্ডারে ফিল্মি গান যেমন আছে, আছে আধুনিক গান, ভক্তিগীতি, লোকসংগীত, গজল আরো অনেক কিছু।
আজ আমরা কুমার শানুর গাওয়া গান নিয়েই যে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবো সেকথা বলাই বাহুল্য। কেননা কোন শিল্পীর মূল্যায়ণ তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে করাটাই রীতি। শিল্পীর শিল্প না থাকলে সেই শিল্পীর পরিচয় অন্তঃসারশূন্য। গান নিয়েই আলোচনা হবে, তবে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। বস্তুত কুমার শানুকে নিয়ে এই জাতীয় আলোচনা এর আগে কখনও হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। সেদিক থেকে আজকের আলোচনা অভিনব তো বটেই, কিছুটা স্পর্শকাতরও বটে। যদিও কাউকে অযথা আঘাত করা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়।
আজ আলোচনা করবো আকেলে হাম হাম আকেলে তুম (১৯৯৫) নিয়ে! ইউনাইটেড সেভেন কম্বাইনসের ব্যানারে মনসুর খান পরিচালিত এই ছবিটি সে বছর বক্স অফিসে তুমুল সাড়া ফেলেছিল। মি. পারফেকশনিস্ট হিসেবে পরিচিত আমির খান এ ছবির নায়ক। একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হত আমির খানের লিপে উদিত নারায়ণ সবথেকে বেশি সুইটাবল। এমন মনে করার একটাই কারণ আমির খানের প্রথম দিককার বক্স অফিস সফল দু একটি ছবিতে (পড়তে হবে দিল, কয়ামত সে কয়ামত তক প্রভৃতি) উদিত নারায়ণের হিট গান। এটা যে শুধু উদিত নারায়ণের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা না, অতীতে বা তার পরেও এই জাতীয় ব্যাপার ঘটেছে। সলমন খানের কণ্ঠ হিসেবে এস.পি বালা সুব্রমনিয়ম একটা সময় পর্যন্ত অগুনতি গান গেয়েছেন। মহঃ আজিজ দীর্ঘদিন পর্যন্ত অমিতাভ বচ্চনের নেপথ্য কণ্ঠ ছিলেন। এমন উদাহরণ অনেক আছে।
বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই ধারাটাকে রীতিমত চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন কুমার শানু। তিনি এসে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওসব ধারা টারা কিস্যু না। নির্দিষ্ট কোন অভিনেতার কণ্ঠ হয়ে নয়,কালে কালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সার্বজনীন একজন সম্পূর্ণ গায়ক। বলিউডের ছোট থেকে বড়, বাদশা থেকে ফকির সবার কণ্ঠেই তিনি অবলীলায় ফিট করে যান। তা যা বলছিলাম, আকেলে হাম আকেলে তুম ছবির ‘রাজা কো রানী সে প্যায়ার হো গয়া…’ গানটির দুটি ভার্সন আছে। একটি গেয়েছেন উদিত নারায়ণ অলকা ইয়াগনিক। অন্যটি কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিক। শোনা যায় যে ‘রাজা কো রানী সে…’ গানটা অনু মালিক কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিককে দিয়েই প্রথমে রেকর্ড করিয়েছিলেন। কিন্তু ছবির পরিচালকের সে গান পছন্দ হয়নি। এক্ষেত্রে তার যুক্তি ছিল গানটি যে মন্দ হয়েছে এমনটা তিনি মনে করেন না ঠিকই, কিন্তু গানটিকে তিনি ছবির যে পর্যায়ে ব্যবহার করতে চাইছেন, তার স্পিরিটের সাথে নাকি এই গানটি যায় না। তিনি সাজেস্ট করলেন কুমার শানু নয়, গানটি উদিত নারায়ণকে দিয়ে গাওয়ানো হোক। সুতরাং অনু মালিক একপ্রকার বাধ্য হয়ে উদিত নারায়ণকে দিয়ে পুনরায় গানটি রেকর্ড করালেন। যদিও মহিলা কণ্ঠটি এক্ষেত্রে একই থাকলেন। মজার বিষয় হলো উদিত নারায়ণকে দিয়ে নতুন করে গানটি রেকর্ড করা হলেও যেহেতু ‘আকেলে হাম আকেলে তুম ছবিটি’ ভেনাস ক্যাসেট কোম্পানির নিজস্ব ব্যানার ইউনাইটেড সেভেন কম্বাইনসের ছবি তাই তারা সিনেমায় অব্যবহৃত কুমার শানুর ভার্সনটিকে ক্যাসেটে রেখে দিলেন। খুব সম্ভবত কুমার শানুর জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্তটি তারা নিয়েছিলেন। এবং তাদের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, সেটা কুমার শানুর গাওয়া গানটির তুমুল জনপ্রিয়তা দেখলেই বুঝতে পারা যায়। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া গানটি আজও বহুল জনপ্রিয়। যত বেশি সংখ্যক মানুষ শুনে থাকেন, ততটা উদিত নারায়ণ ও অলকা ইয়াগনিকের সিনেমায় ব্যবহৃত গানটি শোনা যায় না। এই ছবিতেই কতকটা নিঃশব্দেই আরো একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। ছবিটির আরো একটি বিখ্যাত গান ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’। কুমার শানুর গাওয়া ‘রাজা কো রানী সে প্যায়ার…’ গানটির ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল হুবহু প্রায় একই ঘটনা ‘দিল মেলা চুরায়া’র ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো প্রথম গানটির ক্ষেত্রে গায়কের গায়কী নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলেছিলেন বলে শোনা যায়নি। তবে অন্য শিল্পীকে দিয়ে একই গান দ্বিতীয়বার রেকর্ড করার যৌক্তিকতা কোথায়? এ বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই অবগত আছি যে, ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’
গানটি প্রথমে উদিত নারায়ণকে দিয়ে রেকর্ড করানো হয়েছিল। গানটি মূলত একটি বিচ্ছেদ সংগীত। অন্তত গানটির বাণী এবং সুরের বৈচিত্র্য তেমনটাই দাবি করে। অনু মালিকের করা এ-গানের সুর এককথায় অনবদ্য। যদিও তাঁর সমালোচকরা অনেক খুঁজে পেতে উদ্ধার করেছেন যে গানটির সুর একটি পাশ্চাত্য ধারার সুরের হুবহু অনুকরণ ছাড়া আর কিছু না। এক্ষেত্রে সুরকার একজ তস্করের ভূমিকা পালন করেছেন মাত্র। সে যাই হোক, তা নিয়ে আলোচনা করে প্রতিবেদন দীর্ঘায়িত করাটা অর্থহীন।তা যে কথা হচ্ছিল, উদিত নারায়ণের গাওয়া ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’ গানটি নিয়ে। গানটিকে কেন বাদ দেওয়া হয়েছিল? আর কেনই বা কুমার শানুকে দিয়ে দ্বিতীয়বার রেকর্ড করানোর প্রয়োজন পড়ল? এসব প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। এর উত্তর উদিত নারায়ণ বা কুমার শানুর গাওয়া ভার্সন দু’টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। উদিত নারায়ণ একজন বড় মাপের সংগীত শিল্পী এটা নিয়ে খুব বেশি বিতর্কের অবকাশ আছে বলে হয় না। বস্তুত তিনি তাঁর অভিনব কণ্ঠ মাধুর্যের কারণে একটা বিরাট সংখ্যক শ্রোতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’ গানটির ক্ষেত্রে তিনি অন্তত নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। বস্তুত এই জাতীয় বিষাদের গানে তাঁর সীমাবদ্ধতা ভীষণভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত গানে বিষাদের প্রবল বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে, এই জাতীয় গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর খুব একটা সুখ্যাতি নেই। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটি বিষাদের গান গাইছেন অথচ তাঁর গায়কীর মধ্যে কোনরকমের ভাবের বহিঃপ্রকাশ নেই। নিতান্তই যান্ত্রিক ভঙ্গিমায় একটানা গেয়ে দিয়েছেন। এই পর্যায়ে উদিত নারায়ণের গায়কীর এক বড় সমস্যা ছিল তাঁর সব গানের মধ্যেই অবধারিতভাবে একটা ফিল গুড ব্যাপার প্রকাশিত হত। সে আনন্দের গান হোক কিংবা দুঃখের গান। সব ক্ষেত্রেই তার প্রয়োগ ভঙ্গিমা প্রায় একই ছিল। বৈচিত্র্যহীন একপেশে গায়কী।