🎙️ গুরুদক্ষিণা: কিশোরের শেষ সুরে টলিউডের শ্রদ্ধাঞ্জলি
"বিধাতা দিয়েছে স্বর, তুমি দিলে সুর
স্নেহভরা মমতায় বাধা হল দূর,
সবাকার পদরেণু মাথায় নিলাম,
এ আমার গুরুদক্ষিণা, গুরুকে জানাই প্রণাম।"
এই গান যেন শুধুই একটি গানের কলি নয়—এ এক অভিজ্ঞান। বাংলা গানের ইতিহাসে এমন গান খুব কমই আছে, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে এমন গভীরভাবে গেঁথে গেছে।
১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবির এই গানটি যেন একান্তভাবে জড়িয়ে কিশোর কুমারের অন্তিম সময়ের সঙ্গে। কারণ গানগুলো রেকর্ড করার কিছুদিন পরেই, ১৩ অক্টোবর ১৯৮৭-তে চিরবিদায় নেন গানের রাজপুত্র।
--- "ভাগ্নে, ভালো গানটা তুই গাইবি? ওটা আমি গাইব!"
সময়টা তখন টালিগঞ্জ আর বম্বের মাঝখানে এক সুরেলা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। বম্বের স্টুডিওতে ব্যস্ত সুরকার বাপ্পি লাহিড়ী ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবির টাইটেল ট্র্যাক গাইবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ঠিক সেই সময় ঢুকে পড়লেন কিশোর কুমার। হেসে বললেন—
“কি ভাগ্নে? ভালো গানটা তুমি গাইবে? সেটা হচ্ছে না। ওটা আমি গাইব।”
সেই মুহূর্তেই ইতিহাস লেখা হয়ে গেল।
প্রথমে বাজেটের কারণে ঠিক ছিল, কিশোর কুমার শুধুমাত্র “কোথা আছো গুরুদেব” গানটিই গাইবেন। কিন্তু গানের প্রতি তার ভালোবাসা, ভবেশ কুণ্ডুর কথায় মুগ্ধতা, আর ভাগ্নে বাপ্পির প্রতি স্নেহ—সব মিলিয়ে তিনটি গানই গেয়ে ফেললেন তিনি।
তার মধ্যে ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’ হয়ে উঠল কিংবদন্তি।
--- আশির দশকে টলিউডে বাপ্পির স্বর্ণযুগ
আশির দশক ছিল বাংলা সিনেমার গানে এক জাদুকরী অধ্যায়।
আর. ডি. বর্মণ, অজয় দাস এবং বাপ্পি লাহিড়ীর যুগলবন্দী টলিউডে এনে দিয়েছিল বলিউডের ছোঁয়াচে গ্ল্যামার।
তাঁদের মধ্যে বাপ্পি লাহিড়ীর জন্য ‘গুরুদক্ষিণা’ ছিল এক মাইলস্টোন।
অঞ্জন চৌধুরীর কাহিনিতে বাপ্পির সুর পেয়ে গেল আবেগ, মাটি আর রক্তমাংস।
তাপস পাল ও শতাব্দী রায়ের জুটি তখন সদ্য তৈরি—কিন্তু দর্শক দারুণভাবে আপন করে নেয় তাঁদের। অন্যদিকে এই ছবির মাধ্যমে ফিরলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘গুরুদক্ষিণা’র পর অঞ্জন চৌধুরীর ছবিগুলিতে যেন একের পর এক দেখা গেল তাঁকে—‘বিধিলিপি’, ‘ছোট বউ’ তারই উদাহরণ।
---গোল্ডেন ডিস্ক, গাঁথানির স্বপ্ন আর সেন্ট পলসের মাঠ
গানের জনপ্রিয়তায় ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবি পৌঁছে গেল এক অনন্য উচ্চতায়।
টালিগঞ্জে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হল গোল্ডেন ডিস্ক রিলিজ অনুষ্ঠান—স্থল: সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের মাঠ।
সেই দিন যেন এক উৎসব। গান, স্টার, আবেগ আর ভিড় সব মিলিয়ে টালিগঞ্জে যেন এক বলিউডের বাতাবরণ।
গাঁথানি মিউজিকের কর্ণধার শশীকান্ত গাঁথানি ছিলেন এই আয়োজনের মূল মস্তিষ্ক।
“Welcome to Gathani” লেখা ব্যানারে ঢাকা ছিল গোটা অনুষ্ঠানস্থল।
বাপ্পি লাহিড়ী হাজির ছিলেন বম্বে থেকে তাঁর মা-বাবা—অপরেশ ও বাঁশরী লাহিড়ীকে সঙ্গে নিয়ে।
এইচএমভি-কে সেই সময় কিছুটা হলেও টপকে গিয়েছিল গাঁথানি রেকর্ডস।
আর এক বিস্ময়ের নাম ভবেশ কুণ্ডু—একাধারে এই ছবির প্রযোজক, গীতিকার এবং ভিলেন চরিত্রে অভিনয়! বাংলা সিনেমায় এমন বহুমুখী অবদান বিরল।
---সেই সময়ের কাগজে কী লেখা হয়েছিল?
📌 আনন্দবাজার পত্রিকা (নভেম্বর, ১৯৮৭)
"গুরুদক্ষিণা শুধু একটি ছবি নয়, এক সঙ্গীত সম্মেলন। কিশোর কুমারের শেষ কণ্ঠ মিলিয়ে যায় বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে। বাংলা ছবিতে গোল্ডেন ডিস্কের যুগের সূচনা করে দেয় এই ছবি।"
📌 আনন্দলোক (ডিসেম্বর, ১৯৮৭)
"তাপস-শতাব্দীর রসায়ন যেমন মন জয় করে নেয়, তেমনই গাঁথানির বিপণন কৌশল টালিগঞ্জে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।"
--- কিশোরদার শেষ গান, বাঙালির শেষ ভালোবাসা
‘গুরুদক্ষিণা’ আসলে একটা সিনেমার নাম নয়, এক আবেগ, এক সময়, এক অধ্যায়—যেখানে গান শুধু গান ছিল না, সেটা হয়ে উঠেছিল এক স্মৃতির অনুরণন।
“এই গানগুলো শুধু সুর নয়, এক একটি স্মৃতির দরজা খুলে দেয়। কিশোরদার শেষ সুর যেন আমাদের প্রতি তাঁর শেষ ভালোবাসা।” — বাপ্পি লাহিড়ী, (১৯৮৮-তে এক সাক্ষাৎকারে)